চট্টগ্রাম প্রতিনিধি: টানা ভারি বর্ষণে সৃষ্ট বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়কে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৪০০ কোটি টাকা। সরেজমিনে দেখা গেছে, চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার পশ্চিম ঘাটিয়াডাঙা সড়কটি উপজেলার সদর ইউনিয়ন থেকে ডলু নদীর তীর ঘেঁষে গেছে কাঞ্চনা ইউনিয়ন পর্যন্ত। প্রায় ১০ কিলোমিটার সড়কটি তিনটি ইউনিয়নের বাসিন্দাদের চলাচলের মাধ্যম। সাম্প্রতিক বন্যায় সড়কটি এখন ক্ষতবিক্ষত। ক্ষতিগ্রস্ত এ সড়ক দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে।
গত ৩ থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত অতিবর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার এই ক্ষয়ক্ষতি হয়। একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জেলার ১৩টি উপজেলা ও মহানগরীর বেশিরভাগ সড়ক। তিনটি সংস্থার অধীনে থাকা এসব সড়ক দিয়ে যানবাহন চলাচল কষ্টকর হয়ে পড়ছে।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এসব সড়ক সংস্কারে প্রয়োজন হচ্ছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) অধীনে জেলার ১৫টি উপজেলার মধ্যে ১৩টি উপজেলায় বন্যায় সড়ক, কালভার্ট ও ব্রিজ কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে ৩৩৩টি সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার দৈর্ঘ্য ৩৬১.৭৯৯ কিলোমিটার। টাকার অঙ্কে যার ক্ষতি ৩১৯ কোটি ৯৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৪টি ব্রিজ-কালভার্ট। যার দৈর্ঘ্য ১০১.১৫ মিটার। এতে টাকার অঙ্কে ক্ষতি আট কোটি ১১ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে সড়ক এবং ব্রিজ-কালভার্ট বাবদ ক্ষতি ৩২৮ কোটি ৬ লাখ ৭৬ হাজার টাকা।
এলজিইডির চট্টগ্রামের সহকারী প্রকৌশলী তরিকুল ইসলাম বলেন, বন্যায় জেলার ১৩টি উপজেলায় কমবেশি সড়ক ও ব্রিজ-কালভার্টের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এরমধ্যে ফটিকছড়িতে ১৩টি সড়কের ১.১৬৮ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাটহাজারীতে ৪৪টি সড়কের ৩৪.৫৯৭ কিলোমিটার সড়ক এবং একটি ব্রিজের ৩০০ মিটার ক্ষতি হয়। মীরসরাইয়ে ২০টি সড়কের ২৩.৩ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রাঙ্গুনিয়ায় ৪৭টি সড়কের ৬২.৮৩৬ কিলোমিটার সড়ক এবং একটি কালভার্ট। সীতাকুণ্ডে চারটি সড়কে ১৩.৬ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আনোয়ারায় ১০টি সড়কে ৫.৮৫৬ কিলোমিটার, বাঁশখালীতে ২৯টি সড়কের ৫৯.১৯ কিলোমিটার, বোয়ালখালীতে ৪৪টি সড়কে ৩৬.৮৯৪ কিলোমিটার ও ৮ মিটারের তিনটি কালভার্ট, চন্দনাইশে ১১টি সড়কে ৮.৩৫৬ কিলোমিটার ও ২৫ মিটারের একটি ব্রিজ, পটিয়ায় ১৮টি সড়কে ১৩.৪৬২ কিলোমিটার, সাতকানিয়ায় ২৯টি সড়কে ৬৭.১ কিলোমিটার, রাউজানে ২১টি সড়কে ১০.৫ কিলোমিটার এবং লোহাগাড়ায় ৪৩টি সড়কে ২৪.৯৪ কিলোমিটার এবং ৮টি ব্রিজ-কালভার্টের ৪৯.৩ মিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে বন্যায় এবং জোয়ারের পানিতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নগরীর অধিকাংশ সড়ক। উঠে গেছে কালো আস্তর। সৃষ্টি হয়েছে ছোট-বড় গর্ত। বেড়েছে জনদুর্ভোগ। চসিক সূত্রে জানা গেছে, জলাবদ্ধতায় নগরীতে এক হাজার ৩০০ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ৫০.৭০ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২.১৯৯ কিলোমিটার ড্রেন ও ১.৯৯৩ কিলোমিটার ফুটপাত। এসব সড়ক, ড্রেন এবং ফুটপাত মেরামতে ৬০ কোটি টাকা ব্যয় হবে বলে জানিয়েছেন চসিক কর্মকর্তারা। সরেজমিন দেখা গেছে, নগরীর মুরাদপুর থেকে অক্সিজেন মোড় পর্যন্ত সড়কটি খানাখন্দকে ভরা। এ সড়কের বিভিন্ন স্থানে কার্পেটিং উঠে গিয়ে ছোট-বড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। একই অবস্থা নগরীর বহদ্দারহাট মোড়ে। গুরুত্বপূর্ণ এ মোড়টিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। মুরাদপুর সুন্নিয়া মাদ্রাসা থেকে বহদ্দারহাট সড়কের অবস্থা অত্যন্ত বেহাল। আগে থেকে খানাখন্দ ছিল অক্সিজেন-কুয়াইশ সড়কে। বন্যায় এ সড়কের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। এ ছাড়া মোহরা, রাস্তারমাথা, শুলকবহর, মোহাম্মদপুর, কাতালগঞ্জ, চকবাজার, বাদুরতলা, বাকলিয়া মিয়াখান নগর, ডিসি রোড, ষোলশহর, আগ্রাবাদ কমার্স কলেজ সংলগ্ন এলাকা, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, হালিশহর, পতেঙ্গা, গোসাইলডাঙ্গা সড়কের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ।
চসিকের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে অন্তত ২০টি ওয়ার্ডেই পানি উঠেছে। প্রায় ৫০ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যেগুলো সংস্কারে ব্যয় হবে অন্তত ৬০ কোটি টাকা। আপাতত সড়কের বড় বড় গর্তগুলো ভরাট করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি মো. মুছা বলেন, ‘সাম্প্রতিক বন্যায় নগরীর অধিকাংশ সড়কই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক সড়কে যানবাহন চলাচল কষ্টকর হয়ে উঠেছে। সড়কের খানাখন্দকে পড়ে প্রতিদিনই গাড়ির যন্ত্রাংশ নষ্ট হচ্ছে। এ অবস্থায় নগরীর সড়কগুলো দ্রুত মেরামত করার দাবি জানাচ্ছি।’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘নগরীতে বৃষ্টি ও জোয়ারের পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে জরিপ করেছি। কোথায় কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তালিকা করেছি। ক্ষতিগ্রস্ত এসব সড়ক সংস্কারে ব্যয় হবে ৬০ লাখ টাকা। ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছি। পুরোপুরি যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক করতে প্রায় এক মাস সময় লাগবে।’ সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) চট্টগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা বলেন, ‘উপজেলা পর্যায়ে সওজ আওতাধীন ৩১টি সড়কে ১১৩ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব সড়ক স্বল্পমেয়াদি সংস্কারে ব্যয় হবে ১১ কোটি ৯০ লাখ টাকা এবং দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারে ব্যয় হবে ২৯ কোটি টাকা।’
সাতকানিয়া উপজেলার নলুয়া ইউনিয়নের পূর্ব গাটিয়াডেঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা মো. মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘উপজেলা সদর থেকে কাঞ্চনা পর্যন্ত পশ্চিম খাটিয়াডাঙা সড়কটি অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ সড়ক দিয়ে কাঞ্চনা ইউনিয়নসহ অন্তত তিনটি ইউনিয়নের হাজার হাজার মানুষ চলাচল করে। ডলু নদীর তীর ঘেঁষে সড়কটি গড়ে ওঠার কারণে নদীভাঙনে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ সড়ক দিয়ে এখন যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। একইভাবে নলুয়া ইউনিয়নের হাঙ্গুরমুখ থেকে তালতলা পর্যন্ত সড়ক এবং ঢেঁমশা থেকে কেরানিরহাট পর্যন্ত উপজেলার অধিকাংশ সড়ক কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব সড়ক দিয়ে যানবাহন চলাচল কষ্টকর হয়ে পড়েছে।’